এই পৃথিবীতে সার্ক বা হাঙ্গরদের আগমন ঘটে আজ থেকে প্রায় ৫৪০ মিলিয়ন বছর আগে। তখন কিন্তু গাছ বা বৃক্ষ বলে কোন কিছুর অস্তিত্বই ছিল না। আদীম গাছদের আবির্ভাব হয় তারও প্রায় ১০০ মিলিয়ন বছর পর। তাই সেই হিসেবে গাছেরা হাঙ্গরদের থেকে অন্তত বেশি বুদ্ধিমান হওয়ার কথা। কিন্তু আসলেই কি তাই? হাঙ্গর তো শিকার করতে পারে, শত্রু আক্রমণ করলে লুকাতে পারে। মাঝে মাঝে এরা তো মানুষকেই আক্রমণ করে বসে। আর অন্যদিকে একটা গাছকে দেখে বুদ্ধিহীন নিশ্চল জীব ছাড়া কিছুই মনে হয়না। তবে সাদা চোখে একটা গাছকে দেখে যেমন সাদামাটা বা নির্বোধ মনে হয়, ঘটনা কিন্তু বাস্তবে তেমন না।
অ্যামেরিকার পশ্চিম অংশে প্রশান্ত মহাসাগরের তীর ঘেষে অনেক বনাঞ্চল আছে। এই বনগুলো একদম সবুজে পরিপূর্ণ। কিন্তু এই সবুজ বনের মধ্যে সাদা রঙের এক জাতের ভূতরে গাছ পাওয়া যায়। একে তো এদের রঙ উজ্জ্বল সাদা, তার উপর গাছের প্রকার কোন পাতা নেই। পুরো সবুজ একটা বনের মধ্যে ধবধবে সাদা, পাতাহীন একটা গাছে- সাদা রঙের ফুল ফুটে থাকলে, সেটাকে ভূতুরে গাছ মনে না হলেও বিজ্ঞানীদের মনোযোগ ঠিকই আকর্ষণ করবে। তবে সত্যিই এই গাছের স্থানীয় নাম ghost plant বা ভূতুরে গাছ।
অদ্ভুত এই গাছগুলোকে নিয়ে গবেষণা করতে গিয়ে বের হয়ে আসে গাছেদের এক গোপন জীবনের গল্প। গাছদের এই গল্পের মূল চরিত্র আবার ছত্রাক। উনিশ শতকের শেষের দিকে রাশিয়ান এক বিজ্ঞানী এই গাছের রহস্য ভেদ করতে উঠে পরে লাগেন। কারন গাছ মূলত ক্লোরোফিলের সাহায্যে সূর্যের আলো থেকে খাদ্য তৈরি করে। কিন্তু Monotropa নামের এই ভূতুরে গাছগুলো কয়েক মিলিয়ন বছর আগেই সেই অভ্যাস বাদ দিয়েছে। খাদ্য ছাড়া এই গাছগুলো তাহলে টিকে আছে কি করে- সেটা অনেকদিন ধরেই বিজ্ঞানীদের কাছে একটা ধাঁধা। একটা গাছ ক্লোরফিল ত্যাগ করা বা ফটোসিনথেসিস করা বাদ দেওয়া যে কথা, একটা মানুষ তার মুখ চিরতরে সেলাই করে ফেলাও সেই একই কথা। খাদ্য ছাড়া তো আর একটা জীব বাচতে পারে না।
সাধারণ গাছদের শিকড়ের সাথে Mycorrhiza নামের এক ধরনের ফাঙ্গাস বা ছত্রাক বাস করে। এই ছত্রাকগুলো গাছেদের থেকে পুষ্টি পায়, অন্যদিকে এই ছত্রাকরাও মাটি থেকে গাছগুলোকে খনিজ উপাদান সাপ্লাই করে। কিন্তু ছত্রাকরা তো নিজেরাই পুষ্টি পাওয়ার জন্য গাছেদের উপর নির্ভর করে। তাই ছত্রাকদের দ্বারা এই ভূতুরে কাছগুলোকে পুষ্টি সরবরাহ করা সম্ভব হবে না। পুষ্টি সরবরাহ করতে হলে সেটা আরেক গাছ থেকে ধার করে এনেই এই ভূতুরে কাছগুলোকে দিতে হবে। রাশিয়ান ঐ বিজ্ঞানী ধারণা করলেন যে- মাটির নিচে এই ছত্রাকদের নিশ্চয় কোন নেটওয়ার্ক আছে। ছত্রাকগুলো নিশ্চয় অন্য আরও অনেক ছত্রাকের সাথে কানেকটেড, এবং এই কানেকশনের মাধ্যমে তারা নিশ্চয় কোন নেটওয়ার্ক তৈরি করেছে। আর সেই নেটওয়ার্কের মাধ্যমেই সম্ভবত অন্য কোন গাছ থেকে পুষ্টি উপাদান এনে এই ভূতুরে গাছগুলোকে সরবরাহ করছে। আর এভাবেই হয়ত এই ক্লোরফিলহীন সাদা গাছগুলো বেঁচে আছে।
রাশিয়ান ঐ বিজ্ঞানী এটা নিয়ে একটা রিসার্স পেপারও লিখেছিলেন। কিন্তু সেই সময় ঐ পেপার মূলধারার বিজ্ঞানীদের কাছে তেমন একটা পাত্তা পায়নি। ফলে বিষয়টা প্রায় ৭৫ বছর চাপা পরে থাকে। এরপর সুইডিশ উদ্ভিদবিজ্ঞানী Erik Björkman ১৯৬০ সালে নতুন করে আবার এই গাছ নিয়ে গবেষণা শুরু করেন। তিনি দারুণ একটা বুদ্ধি বের করেন। এই ghost plant এর আশেপাশে সব গাছকে তিনি রেডিওএ্যাকটিভ চিনির ইনজেকশন দেন। রেডিওএ্যাকটিভ পদার্থ যেহেতু অন্ধকারে আলো বিচ্ছুরন করে, তাই সহজেই আসল ঘটনা বোঝা সম্ভব। ছত্রাকরা যদি অন্য গাছে থেকে পুষ্টি সংগ্রহ করে এনে ghost plant কে সরবরাহ করে, তাহলে ghost plant এর ভেতরেও এই রেডিওএকটিভ চিনি পাওয়া যাবে। পরীক্ষা থেকে দেখা গেল ঘটনা সত্য। এই ভূতুরে গাছগুলো এক ধরনের ফাঙ্গাল নেটওয়ার্কের মাধ্যমে আশেপাশের গাছপালার সাথে যুক্ত। আর এভাবেই তারা পুষ্টি সংগ্রহ করে।
পরীক্ষাটা থেকে এই প্রথমবারের মত এটা প্রমাণ হলো যে, ফাঙ্গাস বা ছত্রাকের নেটওয়ার্কের মাধ্যমেও বিভিন্ন ধরণের উপাদান আদান প্রদান সম্ভব। এরপর বিজ্ঞানীরা এই বিষয়টা নিয়ে আরও অনেক গবেষণা করতে থাকেন। ১৯৮০ সালের মধ্যে এই গবেষণা অনেক দূর আগায়। ততদিকে আমরা জানতে পারি যে- এই ভূতুরে গাছগুলোর এই ফাঙ্গাল নেটওয়ার্ক মোটেই কোন বিচ্ছিন্ন ঘটনা না। পৃথিবীর বেশিরভাগ গাছই এমন ফাঙ্গাল নেটওয়ার্কের মাধ্যমে যুক্ত। একটা গাছ যেমন অনেকগুলো ফাঙ্গাল নেটওয়ার্কের সাথে যুক্ত থাকতে পারে, তেমনি ফাঙ্গাসরাও একাধিক গাছের সাথে তাদের নিজস্ব নেটওয়ার্কের মাধ্যমে যুক্ত থাকতে পারে।
এরপর এই বিষয়টা বিজ্ঞানীমহলে রীতিমত সাড়া ফেলে দেয়। ধীরে ধীরে জানা যায় যে- ছত্রাক আর গাছরা মিলে মাটির নিচে রীতিমত এক ইন্টারনেট তৈরি করে বসে আছে। আমরা যেমন মেসেঞ্জারে চ্যাট করি, গাছেরাও বলতে গেলে আমাদের থেকে কম যায় না। পল স্ট্যামেটস নামে এক ছত্রাক বিশেষজ্ঞ ইলেকট্রন মাইক্রোস্কোপের নিচে ছত্রাকদের এই নেটওয়ার্ক কিভাবে তৈরি হয় তা খুটিয়ে দেখছিলেন। তিনি ছত্রাকের মাইসেলিয়াম নেটওয়ার্কের সঙ্গে অ্যামেরিকার ডিপার্টমেন্ট অব ডিফেন্সের তৈরি করা ইন্টারনেটের একেবারে প্রথম সংস্করণ, অর্থাৎ ARPANET মধ্যে মিল খুঁজে পান। এজন্যই তিনি ওয়ার্ল্ডওয়াইড ওয়েব (World Wide Web) বা www এর আদলে গাছেদের এই ইন্টারনেটের নাম দেন উডওয়াইড ওয়েব (Wood Wide Web)।
এক গাছ আরেক গাছের সাথে বিভিন্ন ধরনের তথ্য আদান প্রদান করতে পারে। ইন্টারনেটের ক্ষেত্রে যেমন সাবমেরিন কেবল বা অপটিক্যাল ফাইবার ব্যবহার করা হয়, তেমনি গাছেরাও ছত্রাকের সাহায্যে এক ধরনের নল তৈরি করে। এই নলগুলোকে বলা হয় হাইফা। এই হাইফার সাহায্যে তথ্য পাঠানো যায়, বিভিন্ন ধরণের রাসায়নিক পাঠানো যায় এবং খাদ্যও পাঠানো যায়।
ব্রিটিশ কলাম্বিয়া ইউনিভার্সিটির সুজান সিমার্ড ১৯৯৭ সালের দিকে আরেক ঘটনা আবিষ্কার করেন। তার গবেষণায় দেখা যায় যে মানুষ যেমন বিপদের দিনে মানুষকে ত্রান সহায়তা করে, তেমনি ব্যবস্থা গাছেদের মধ্যেও প্রচলিত আছে। ডগলাস ফার নামের এক ধরনের পাইনগাছ এবং পেপার বার্চগাছ নিজেদের মধ্যে কার্বন ভাগাভাগি করে খায়। অনেক সময় ফসফরাস বা নাইট্রোজেনের মত বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ খনিজ উপাদানের অভাব দেখা যায়। তখন এক গাছ অন্য গাছকে বিপদের দিনে নাইট্রোজেন বা ফসফরাসের মত জীবনরক্ষাকারী খনিজ দিয়ে সাহায্য করে।
অনেক মা গাছ তাদের চারা গাছগুলোকে তারাতারি বড় করে তোলার জন্য পুষ্টি উপাদান পাঠায়। কিন্তু ব্যপারটা এখানেই আটকে নেই। কিছু কিছু গাছ যখন বুঝতে পারে যে সে আর বাচতে পারবে না, তখন যে তার নিজের জমানো সব খাবার আশেপাশের প্রতিবেশিদের মধ্যে বিলিয়ে দেয়। যে সেহেতু জানেই যে বাচবে না, তাই খাবার নষ্ট না করে অন্যদের মধ্যে বিলিয়ে দেয়।
আমরা যে ভূতুরে গাছের কথা বলেছিলাম যেই গাছ কিন্তু ছত্রাকদের কোন খাদ্য সরবরাহ করে না। তাই এখানে সিমবায়োটিক কোন সম্পর্ক নেই। এখানে মূলত আশেপাশের গাছগুলোই এই ভূতুরে গাছগুলোকে দানখয়রাৎ করে বাচিয়ে রাখছে। এইসব বিষয় থেকে গাছদের মধ্যে স্পষ্টভাবেই বুদ্ধিমত্তা এবং সামাজিক সম্পর্কের আন্দাজ পাওয়া যায়।
এই নেটওয়ার্কটা শুধুমাত্র খাবারদাবার আদানপ্রদানের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নেই। এক গাছ যখন বিপদে পরে তখন অন্য গাছেদের কাছে সেই বিপদের সংকেট পাঠায়। ২০১০ সালে চায়না অ্যাগ্রিকালচারাল ইউনিভার্সিটির রেন সেন যেং টমেটো গাছ নিয়ে একটা পরীক্ষা করেন। তিনি এবং তার দল অনেকগুলো পাত্রে এক জোড়া করে টমেটোগাছ লাগান। এর মধ্যে কিছু কিছু গাছকে ছত্রাকের সেই নেটওয়ার্ক তৈরি করতে দেওয়া হয়, কিন্তু বাকিগুলোকে বিচ্ছিন্ন রেখে দেওয়া হয়। একটা নির্দিষ্ট সময় পর প্রতিটি পাত্রের একটি গাছকে তারা রোগাক্রান্ত করার চেষ্টা করেন। তারা অবাক হয়ে লক্ষ করেন যে- যেসব জোড়ায় ফাংগাসের নেটওয়ার্ক ছিল, সেসবের ক্ষেত্রে দ্বিতীয় গাছটা কম ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। অর্থাৎ দ্বিতীয় গাছটাকে প্রথমে আক্রান্ত গাছটা সংকেত পাঠিয়ে সতর্ক করে দিয়েছে। ফলে দ্বিতীয় গাছটা সতর্ক হয়ে নিজেদের ইমিউনিটির সাহায্যে শত্রুর বিরুদ্ধে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিয়েছে এবং কম ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে।
এখন নেটওয়ার্ক যেখানে আছে, সেখানে হ্যাকিং হওয়ার সম্ভাবনাও থেকে যায়। শুনতে অদ্ভুত লাগলেও বিজ্ঞানীরা গাছেদের মধ্যে হ্যাকার গাছেরও সন্ধান পেয়েছেন। এরা তাদের আশেপাশের নিরীহ উদ্ভিদদের খাবারে অন্যায়ভাবে ভাগ বসায়। কিছু কিছু গাছ আবার মানুষের মত পরশ্রীকাতর। এরা খাবারে ভাগ না বসিয়ে বরং এই ফাংগাস নেটওয়ার্ক ব্যবহার করে অন্য গাছের ক্ষতি করে। এরা বিষাক্ত পদার্থ ছেড়ে দিয়ে অন্য গাছের বৃদ্ধি ব্যাহত করে। কিছু কিছু গবেষণা থেকে এটাও প্রমাণিত হয়েছে যে, কিছু গাছ নাকি মৃত্যুর হুমকিও দেয়। এই ধরনের অনেক গাছের ক্লোরোফিল নেই, ফলে সালোকসংশ্লেষণের মাধ্যমে নিজেদের খাদ্য নিজেরা তৈরি করতে পারে না। এ ধরনের একটি গাছ হলো ফ্যান্টম অর্কিড। এই অর্কিডগুলো তাদের পার্শবর্তী গাছ থেকে ফাঙ্গাল নেটওয়ার্কের সাহায্যে কার্বন চুরি করে নিয়ে নিজেরা খেয়ে ফেলে।
গাছেরা এই যা কিছু করছে, এই সবকিছু সম্ভব হয়েছে মূলত ফাঙ্গাস বা ছত্রাকের কারনে। শুধু গাছই নয়, ছত্রাকরা এই পৃথিবীর বাস্তুসংস্থানের অনেক বড় একটা অংশে প্রভাব খাটায়, এমনকি নিয়ন্ত্রণও করে। ভাবলে অবাক হতে হয়, এই ছত্রাকেরা আমাদের কৃষি, মেডিসিন এমনকি আমাদের চিন্তা-চেতনাকে পর্যন্ত প্রভাবিত করে। ছত্রাকদের এই গোপন রাজ্য বাইরে থেকে কিছু বোঝা না গেলেও- এরা একদিকে যেমন গাছেদের ইন্টারনেট হিসেবে কাজ করে, তেমনি আমাদের মন বা চিন্তাকেও প্রভাবিত করে। আমরা বাইরে থেকে খালি চোখে জীবজগতের যে অংশটা দেখি তার বাইরেও আণুবীক্ষণিক জগতে প্রতিনিয়ত অনেক ইন্টারেস্টিং ঘটনা ঘটে চলেছে।
ক্যাম্ব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইকোলজিতে ডক্টরেট করা জীববিজ্ঞানী Merlin Sheldrake ফাঙ্গাসদের এই আশ্চর্য জগত এবং আমাদের উপর তাদের প্রভাব নিয়ে দুর্দান্ত এক বই লিখেছেন। নাম Entangled Life: How Fungi Make Our Worlds, Change Our Minds & Shape Our Futures । তিনি খুবই তরুণ একজন বিজ্ঞানী। এখন তার বয়স মাত্র ৩৬ বছর। কিন্তু এই বয়সে একটা মাত্র বই লিখেই তিনি রীতিমত বিশ্ববিখ্যাত হয়ে গেছেন। জীবজগত, ইকোসিস্টেম, জীবজগতের সবাই কিভাবে সবার সাথে কানেকটেড, এই বিষয়গুলো নিয়ে বইয়ের সংখ্যা খুব কম। কিন্তু এই বিষয়গুলো একদিকে যেমন কৌতূহল উদ্দিপক, অন্যদিকে গুরুত্বপূর্ণ। তাই আমাদের পৃথিবীর ইকোসিস্টেম নিয়ে বিজ্ঞানীদের আগ্রহ দিন দিন বেড়েই চলেছে। এই ধরনের বিষয়গুলো নিয়ে যাদের আগ্রহ আছে তাদের জন্য এই বইটা অবশ্যপাঠ্য।
Reviews
There are no reviews yet.